“যাত্রা শুরুর পর থেকে এত পরিমাণ লাভের মুখ দেখেনি কেরু: রাব্বিক হাসান
স্বাধীনতার ৫৪ বছর সরকারের রাজস্ব খাতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন
শিমুল রেজা,
চুয়াডাঙ্গা তথা এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি কেরুজ চিনিকল। এশিয়া মহাদেশের ২য় বৃহত্তম ও বাংলাদেশের সর্ববৃহত্তম ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি সোনালী অতিত ঐতিহ্য রয়েছে। দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান যোগদানের পর, মাত্র ১ বছর দ্বায়িত্ব পালন করেই বদলে দিয়েছেন কেরু এন্ড কোম্পানীর সকল প্রকার, সিন্ডিকেট টেন্ডার বানিজ্য সহ নানান অনিয়ম, এই অনিয়ম দূর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করার ফলে কেরু এন্ড কোম্পানীটি আগের তুলনায় সর্বোচ্চ লাভজনক অবস্থানে পৌঁছিয়েছে, সুগার মিলটির ডিস্টিলারি বিভাগের উন্নয়ন, কেরুর শ্রমিক সংকট সমাধান, রাসায়নিক ও জৈব কারখানার উন্নয়ন সহ বেশ কিছু দৃশ্যমান কাজ করে প্রশংসায় প্রশংশিত কেরু এন্ড কোম্পানির এম ডি রাব্বিক হাসান। ৮৮ বছর বয়সি মিলটি সম্প্রতি আধুনিকতার ব্যাপক উন্নয়নের ছোয়া লাগতে শুরু করেছে। ডিস্টিলারী কারখানাটিরো ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। মিলটি আধূনিকায়ন, ডিস্টিলারী কারখানায় অটোমেশিন স্থাপন সহ বিভিন্ন উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে সম্প্রতি সময়ে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মিলের রাজস্ব ও লোকসানের সঠিক হিসেব কেউ দিতে না পারলেও স্বাধীনতার পর থেকে মিলটিতে কয়েক মরসুম চিনি কারখানায় লোকসান গুনলেও মুনাফা অর্জনের অংকটা বেশ বড়। গত কয়েক অর্থ বছরে মুনাফা অর্জনের পরিমান বেড়েই চলেছে।
তারই ধারাবাহিকতায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে শুধু ডিস্টিলারি বিভিন্ন ইউনিট থেকে মদ বিক্রি করে কেরু ১৪০ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েও
লাভ হয়েছে ১৩০ কোটি টাকারও বেশি, যা কোম্পানির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। ও চিনি কারখানার প্রায় সাড়ে ৬২ কোটি লোকসান পুষিয়েও মুনাফা অর্জন হয়েছে ১শ সাড়ে ২৯ কোটি টাকা। ডিস্টিলারী বিভাগের লাভের টাকায় কেরুজ চিনিকল কারখানা বিভাগের মোটা অংকের লোকসান পোষাতেও হচ্ছে বছর কয়েক ধরে। খামারগুলোতে দীর্ঘ বছর লোকসান গুনলেও গত ২৪-২৫ অর্থ বছরে সে রেকর্ড ভেঙ্গে দেখেছে সর্বোচ্চ লাভের মুখ, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্সের ৬টি বিভাগের মধ্যে ৫টিতেই মুনাফা অর্জন হয়েছে। চিনি কারখানায় ৬২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লোকসান হলেও ডিস্টিলারী বিভাগে মুনাফা অর্জন হয়েছে ১৯০ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। বানিজ্যিক খামারগুলো থেকে মুনাফা অর্জন হয়েছে ৩৬ লাখ ৯ হাজার টাকা।আকন্দবাড়িয়া পরিক্ষা মূলক খামার থেকে মুনাফা অর্জন হয়েছে ৩৩ লাখ ২ হাজার টাকা। ৭৮ লাখ ৩৬ হাজার টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে আকন্দবাড়িয়া জৈব সার কারখানায়। এ ছাড়া ফার্মাসিটিক্যাল বিভাগে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে। চিনি কারখানার লোকসান পুষিয়েও সরকারের রাজস্ব খাতের মধ্যে মাদক শুল্ক ৮১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭০৭ টাকা, ট্যাক্স ৩২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ও ভ্যাট জমা দিতে হয়েছে ২৫ কোটি ৬৩ লাখ ২১ হাজার ৯৪৮ টাকা। ফলে সরকারের রাজস্ব খাতে ১৪০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। চিনি কারখানায় লোকশান পুষিয়ে, সরকারের বিভিন্ন খাতে প্রায় ১শ সাড়ে ৪০ কোটি রাজস্ব জমা দিয়েও মুনাফা অর্জন হয়েছে ১২৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসান বলেন, "যাত্রা শুরুর পর থেকে এত পরিমাণ লাভের মুখ দেখেনি কেরু।, মাননীয় শিল্প উপদেষ্টা মহোদয়, শিল্প সচিব মহোদয় ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান এর সার্বিক দিকনির্দেশনায় মোতাবেক, দেশের ঐতিহ্যবাহী চিনি শিল্প এই কেরু অ্যান্ড কোম্পানি অন্যান্য পণ্যে উৎপাদন সহ এই চিনি শিল্পকে এগিয়ে নিতে এবং সর্বোচ্চ লাভজনক হিসাবে পরিনত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। যা ইতিমধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। যার মধ্যে আখের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, ভালো মানের বীজ নির্ধারণসহ কৃষি কাজে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। আগের তুলনায় এবার চিনিকলের লোকসানের কমে আসবে এবং আগামীতে তা লাভজনক হিসাবে রুপান্তরিত হবে বলে আমি আশাবাদী। চিনিশিল্পের প্রধান কাঁচামাল আখ। চিনিশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আখ চাষের কোন বিকল্প নেই। আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরের সর্বোচ্চ লাভের দিকে অগ্রসর হবে কেরু ইনশাল্লাহ।
কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর প্রতিষ্ঠালগ্ন ৮৮ বছর বয়সি মিলটি বিগত দিন সম্পর্কে আসুন কিছু জানা যাক, বাংলাদেশের শিল্প স্থাপনা গুলোর মধ্যে কেরুজ চিনিকল একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ দর্শনায় চিনিশিল্প, ডিষ্টিলারী ও বানিজ্যিক খামারের সমন্বয়ে এ বৃহত্তর শিল্প কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠিত। ১৮০৫ সালে মিঃ জন ম্যাক্সওয়েল নামক এক ইংরেজ তাঁর ঐক্লান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামক স্থানে একটি মদের কারখানা চালু করেন। সময়ের বিবর্তনে নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যাবসায়িক কর্মকান্ড পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মিঃ রবার্ট রাসেল কেরুর সাথে অংশিদারিত্বে যুক্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যে মি. রবার্ট রাসেল তার অংশ বিক্রি করে দেন।
১৮৫৭ সালে ভারতের রোজতে সিপাহী বিপ্ল¬বের সময় প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অতঃপর তা পূনঃনির্মান পূর্বক জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানী গঠন করে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী লিঃ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরন করা হয়। রোজতে ব্যাবসায় উন্নতি লাভ করায় আসানসোল ও কাটনীতে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালে চিনি কারখানার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ইংল্যান্ডের মেসার্স বে¬য়ার্স লিঃ ও গ¬াসগো প্রতিষ্ঠান। সে সময় বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় ১১ হাজার ৫ শ মেট্রিক টন। অপর দিকে ডিষ্টিলারী কারখানায় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ফ্রান্সের মেসার্স পিনগ্রিসইটি মোলেট। প্রাথমিক ভাবে দৈনিক ১ হাজার টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরীর লক্ষে আরো একটি শাখা তদানিন্তন নদীয়া জেলার অর্ন্তগত দর্শনায় স্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর এটি পরিনত হয় শত্রু সম্পত্তিতে। ১৯৬৮ সালে কেরু এ্যান্ড কোং (পাকিস্থান) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিআই’র ডিসি’র উপর ন্যাস্ত করার সরকারী প্রচেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অকার্যকর হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করন করা হয় এবং তখন থেকে অদ্যবদি কেরু এ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিঃ নামে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
এখানে চিনি, রেকটিফাইড স্পিরিট, দেশীমদ, বিলাতী মদের ৯টি ব্রান্ড উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে (গোল্ড রিবেন্ড জিন, রোজা রাম, ওল্ডরাম, ফাইন ব্রান্ডি, চ্যাইরি ব্রান্ডি, ইম্প্রেরিয়াল হুইস্কি, মলটেড হুইস্কি, অরেন্স ক্রাকাউ, জারিনা ভদকা)। প্রায় ১৬ বছর ধরে মলটেড হুইস্কি উৎপাদন রয়েছে বন্ধ। কারণ হিসেবে জানা গেছে, জার্মানের বুসবুক কোম্পানী বন্ধ হওয়ার কারণে মদ উৎপাদনের ফ্লেবার ও কাচামাল আমদানি সম্ভব হচ্ছেনা। যে কারণে মলটেড হুইস্কি উৎপাদন রয়েছে বন্ধ। নেদারল্যান্ডে ইন্টার ন্যাশলান ফ্লেবার এ্যান্ড ফ্রাগনেন্স কোম্পানী সব ধরণের ফ্লেবার সরবরাহ করলেও মলটেড ফ্লেবার সরবরাহ করতে পারেনা। কেরুজ কমপ্লেক্সে উৎপাদন করা হয় ভিনেগার ও জৈব সার। মিলটির অন্যতম উপজাত দ্রব্য আখ, চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাট। প্রায় ২১ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ওষুধ তৈরী কারখানাটি। বছর দশেক আগে কেরুজ চিনিকলের আরো একটি শাখা বাড়ানো হয়েছে।
কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব জমিতে স্থাপন করেছে জৈব সার কারখানা। এ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমির পরিমান খামার ৩ হাজার ৩শ ৩৫ দশমিক ৫৬ একর। কারখানা ও কলোনী ১৬৬ দশমিক ১৮ একর জমিতে। ইক্ষুক্রয় কেন্দ্র ৫ দশমিক ৩০ একর জমিতে। নিজস্ব সড়কের জমির পরিমান ৪৮ দশমিক ৩৫ একর ও শ্মষান ১ দশমিক ২৭ একর। আকন্দবাড়িয়া জৈব সার কারখানা ২৭৯ দশমিক ৭২ একর জমির উপর। ৯টি বানিজ্যিক খামারের মধ্যে রয়েছে হিজলগাড়ি, বেগমপুর, ফুরশেদপুর, ঝাঝরি, আড়িয়া, ফুলবাড়ি, ছয়ঘরিয়া, ঘোলদাড়ী ও ডিহিকৃষ্ণপুর। এ প্রতিষ্ঠানে জনবল রয়েছে অফিসার ও স্থানীয় এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। কেরুজ চিনিকলটি আধুনিয়কায়নের কাজ সম্পন্ন হলে শ্রমিক-কর্মচারির সংখ্যা কমতে পারে বলেও ধারণা অনেকের। তবে আধুনিকায়নের কার্যক্রম শেষ কবে নাগাদ হবে তা বুঝা মুশকিল। অপরদিকে কৃষি খামারের সংখ্যা ১০ টি, ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা মিলগেটে ২ টি, রোড ভিত্তিক ৩৩ টি। দেশ ব্যাপী দেশী মদ বিক্রয় কেন্দ্র ১৩ টি ও ফরেন লিকার বিক্রয় কেন্দ্র ৪টি। ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্টিত আয়-ব্যায়ের সঠিক হিসেব জানা না গেলেও স্বাধীনতার পরবর্তি সময়ে কেরুজ চিনিকলের সবকটি বিভাগের সমন্বিত হিসাব অনুযায়ি গত ৫৩ বছরের সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা হয়েছে ১ হাজার ৯শ ৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। কয়েক বছর মিলের চিনিকল কারখানা, জৈব সার কারখানা ও খামারগুলো থেকে লোকসান হলেও তা পুষিয়ে দেয়া হয়েছে ডিস্টিলারী কারখানার উপার্জনের টাকায়। সব লোকসান পুষিয়েও স্বাধীনতা পরবর্তি ৫২ বছরে মুনাফা অর্জনের অংকটাও বড় মাপের।
সম্প্রতি সময়ের হিসেব অনুযায়ি ২০০৯-১০ অর্থ বছরে কেরুজ কমপে¬ক্স থেকে ৫৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা সরকারকে রাজস্ব দিয়েও মুনাফা অর্জন হয়েছে ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা। ২০১০-১১ অর্থ বছরে ৬১ কোটি ৩২ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে দিয়েও লাভ হয়েছে ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ২০১১-১২ অর্থ বছরে মুনাফা অর্জন হয়েছে ২০ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এ অর্থ বছরের সরকারকে রাজস্ব দেয়া হয়েছে ৬৭ কোটি ৭২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সরকারের রাজস্ব খাতায় ৬৯ কোটি ৪০ টাকা জমা দিয়েও মুনাফা অর্জিত হয়েছে ২২ কোটি ৩২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে মুনাফা অর্জন হয়েছে ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা। সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দেয়া হয়েছে ৭১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। স্মরণকালে কম মুনাফা অর্জন হয়েছে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে। হিসেব অনুযায়ি ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে মুনাফা অর্জন হয়েছে মাত্র ৪ কোটি ১৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা। সরকারকে রাজস্ব্ দেয়া হয়েছে ৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে রাজস্ব দেয়া হয়েছে ৬২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মুনাফা অর্জন হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৬৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে মুনাফা অর্জিত হয়েছে ৭ কোটি ৪০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সরকারের খাতায় রাজস্ব জমা হয়েছে ৭৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
মুনাফা অর্জন হয়েছে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সরকারের রাজস্ব খাতে ৭৩ কোটি ৮২ লাখ জমা দিয়েও মুনাফা অর্জন করেছে ৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। ওই অর্থ বছরে চিনি কারখানার ৬০ কোটি টাকা, বানিজ্যিক খামারে ২ কোটি লোকসান ও ১৯৭ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ ১৭ কোটি টাকা সহ সর্বমোট টাকার পরিমান দাড়ায় ৭৯ কোটি টাকা লোকসান পুষাতেও হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা দিয়ে, চিনি কারখানা, খামার ও জৈব সার কারখানার লোক পুষিয়েও মুনাফা অর্জন হয়েছিলো ৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে সরকারকে রাজস্ব দেয়া হয়েছে ৮০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। চিনি কারখানা, খামার ও সার কারখানার লোকসান পুষিয়ে ওই অর্থ বছরে মুনাফা অর্জন হয়েছিলো ১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্সের ৪ টি বিভাগের মধ্যে চিনি কারখানা ও ৯ টি খামারে লোকসান গুনেছে ৬৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ দিকে মুনাফা অর্জন হয়েছে ডিস্টিলারী, হ্যান্ড সেনিটাইজার ও ও সার কারখানায়। ওই অর্থ বছরে সরকারকে ১১৪ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েও মুনাফা অর্জন হয়েছে ৪৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্স থেকে সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা দেয়া হয়ে ১৪৫ কোটি টাকা। চিনি কারখানার সাড়ে ৬৮ কোটি টাকা লোকসান পুষিয়েও ৮০ কোটি টাকা মুনাজা অর্জন হয়েছে কেরুজ কমপ্লেক্সে। ২০২২-২৩ মরসুমে চিনি কারখানার প্রায় ৬৮ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০২৩-২৪ আখ মাড়াই মরসুমে যাত্রা শুরু করলেও মূল লক্ষ ছিলো মুনাফা অর্জন। অনিরিক্ষিত তথ্যনুসারে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৪৬৯ প্রুপ লিটার মদ উৎপাদন করা হয়েছে কেরুজ ডিস্টিলারীতে।
এর মধ্যে বাজারজাত করা হয়েছে ফরেণ লিকার (বিলেতি মদ) ২ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৪ কেচ। এবার ফরেন লিকার (বিলেতি মদ) ও বাংলা মদ (দেশী মদ) বাজারজাত করা হয়েছে ৪৫৯ কোটি টাকার। যা গত অর্থ বছরের তুলনায় অনেকটা বেশী। যা গত অর্থ বছরের তুলনায় উৎপাদন ও বাজারজাত বেশী না হলেও মাঝামাঝি সময়ে দাম বৃদ্ধি হওয়ায় টাকার অংক বেড়ে যায়। ফলে ডিস্টিলারী বিভাগ থেকে মুনাফা অর্জন হয়েছে ১৭৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। বরাবরের মতই লোকসান গুনতে হয়েছে চিনি কারখানায়। চিনি কারখানার লোকসানের পরিমান ৬০ কোটি ৩৩ লাখ। এ ছাড়া আকন্দবাড়িয়া জৈব সার কারখানায় ২১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে। তবে ৩০ বছরের লোকসানের রেকর্ড ভেঙ্গেছে পরপর দু অর্থ বছরে বানিজ্যিক খামারগুলোতে। চিনিকলের ৯ টি খামার থেকে ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। জৈব সার কারখানায় ৫৩ লাখ ২৪ হাজার ও ফার্মাসিটিক্যালে মুনাফা অর্জন হয়েছে ২০ হাজার টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্স থেকে সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা দেয়া হয়ে ১৪২ কোটি ১০ লাখ টাকা। চিনি কারখানার ৬০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা লোকসান পুষিয়েও ১১৩ কোটি ৫৮ লঅখ টাকা মুনাজা অর্জন হয়েছে কেরুজ কমপ্লেক্সে।
যা চিনিকল প্রতিষ্ঠালগ্নে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। কেরুজ কমপ্লেক্স একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান বলেন, এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি কেরুজ কমপ্লেক্স। সর্বক্ষেত্রে কেরুজ চিনিকলের রয়েছে অবদান। সরকারের এ মূল্যবান সম্পদ গর্বিত ও সমৃদ্ধ করেছে এ জেলা তথা দর্শনাকে। তাই এলাকার বৃহত্তর স্বার্থে এ প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্যতম কাচামাল আখচাষ বাড়ানো খুবই জরুরী। কেরুজ কমপ্লেক্সে যে যেখানে যে যে দায়িত্বে রয়েছেন, তাদেরকে নিষ্টা, আন্তরিকতার মধ্যদিয়ে কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাহলেই রক্ষা পাবে চিনি কারখানা, এ অঞ্চল ফিরে পাবে সোনালী অতীত। তাই আসুন কেরুজ চিনিকলকে বাচাই নিজেদের স্বার্থে।
পাশপাশি কৃষকদের সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করণেও আমরা সচেষ্ট। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সামাজিক উন্নয়নে অর্থ বরাদ্ধ দিয়ে থাকে। তার মধ্যে রয়েছে ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি হাফেজিয়া মাদ্রাসা, ১ টি জামে মসজিদ, সুগার সেচ ও রোড ডেভলপমেন্ট ফান্ড হতে মিলজোন এলাকাতে চাষিদের ইক্ষু পরিবহনের সুবিদার্থে এলাকার রাস্তা, কালভার্ট নির্মান ও মেরামতে অর্থ দেয়া। শিক্ষা সেচ তহবিলের আওতায় এলাকার স্কুল কালেজ ও মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য আর্থিক অনুদানও প্রদান করা হয়ে থাকে। শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে একটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। সবকিছু মিলিয়ে এলাকায় অর্থসামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি হিসেবে বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের মূল্যবান সম্পদ কেরুজ চিনিকলটি টিকিয়ে রাখতে বেশী বেশী আখচাষের কোন বিকল্প নেই।