প্রযুক্তির এই যুগে এসে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সীমানাগুলো ক্রমেই আবছা হয়ে আসছে। একসময় আমাদের জীবন ছিল একান্তই নিজেদের, যেখানে ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা, আনন্দ, কষ্ট— সবকিছুরই একটি নিজস্ব পরিসর ছিল। কিন্তু এখন সেই পরিসরটা আর নেই। বিশেষ করে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের জীবনকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছে যে, আমরা নিজেদের অজান্তেই যেন এক বিশাল অ্যারেনায় অভিনেতা হয়ে গিয়েছি। আর এই উন্মুক্ত জীবনের পেছনে অণুঘটক হিসেবে করছে মনিটাইজেশন বা অর্থ উপার্জনের লোভ।
ফেসবুক মনিটাইজেশন কোনো নতুন ধারণা নয়। বহুদিন ধরেই এটি কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য একটি আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করছে। ইন-স্ট্রিম অ্যাড, রিলস বোনাস প্রোগ্রাম, ফ্যান সাবস্ক্রিপশন, ব্র্যান্ড পার্টনারশিপ— এমন নানা উপায়ে ফেসবুক থেকে অর্থ উপার্জন করা যায়। এই সুযোগগুলো অনেক প্রতিভাবান মানুষকে নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। অনেকে শিক্ষামূলক, সৃজনশীল বা বিনোদনমূলক কনটেন্ট তৈরি করে নিজেদের পরিচিতি গড়েছেন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি ইতিবাচক দিক মনে হলেও, এর পেছনের অন্ধকার দিকটি কিন্তু আরও গভীর।
যখন কোনো কাজের মূল উদ্দেশ্য হয় শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন, তখন সেই কাজের নৈতিকতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফেসবুকেও ঠিক এটাই ঘটছে। মনিটাইজেশন পেতে হলে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়, যেমন— ফলোয়ার সংখ্যা, ওয়াচ টাইম ইত্যাদি। এই শর্তগুলো পূরণ করার জন্য অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর মরিয়া হয়ে ওঠেন। সুস্থ প্রতিযোগিতা তখন অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় রূপান্তরিত হয়। তাদের লক্ষ্য থাকে কীভাবে দ্রুত বেশি ভিউ, লাইক এবং শেয়ার পাওয়া যায়। আর এই লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা বেছে নেন এমন সব পথ, যা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে বিকিয়ে দেয় এবং তাদের আচরণকে হাস্যকর ও অদ্ভুত করে তোলে।
এককালে মানুষ ফেসবুকে নিজেদের আনন্দের মুহূর্তগুলো ভাগ করে নিত, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। কিন্তু এখন সেই সাধারণ ব্যবহারকারীরাও নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়কে "কনটেন্ট" হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। একজন ব্যবহারকারী যখন তার পেটে ব্যথা নিয়েও ভিডিও লাইভে আসেন, বা তার পরিবারের একান্ত ব্যক্তিগত ঝগড়াকে সবার সামনে তুলে ধরেন, তখন বোঝা যায়, অর্থ উপার্জনের নেশা তাকে কতটা গ্রাস করেছে। ব্যক্তিগত দুঃখ, কষ্ট, এমনকি চরম দুর্দশার মুহূর্তগুলোও তখন আর ব্যক্তিগত থাকে না। সেগুলোকে হাসিমুখে বা কান্নার অভিনয় করে ভিডিওতে ধারণ করা হয়, কারণ এই ধরনের নাটকীয় কনটেন্ট বেশি ভিউ পায়। এই প্রক্রিয়ায় আমরা নিজেদের আবেগ, সম্মান এবং ব্যক্তিগত মর্যাদাটুকুও বিক্রি করে দিচ্ছি।
এই যে ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কনটেন্টে পরিণত করার প্রবণতা, তা শুধু নিজের গোপনীয়তাকেই নষ্ট করছে না, বরং একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল সমাজকে বিকৃত করে তুলছে। যখন একজন মানুষ রাস্তায় কাউকে সাহায্য করার জন্য প্রথমে ক্যামেরা অন করে, বা গরিব মানুষকে খাবার দেওয়ার আগে নাটকীয়ভাবে তার দুঃখ বর্ণনা করে, তখন মানবতা আর মানবতা থাকে না; তা হয়ে যায় একটি মুনাফা-উপার্জনকারী প্রকল্প। এই ধরনের কনটেন্ট সমাজের মৌলিক মূল্যবোধকে দুর্বল করে দেয়। মানুষের স্বাভাবিক সহানুভূতি ও সততার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়, কারণ প্রতিটি ভালো কাজকেও তখন সন্দেহজনক মনে হয়।
এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষ যেন নিজেদের অজান্তেই 'জোকার' বনে যাচ্ছে। জোকার মানে সেই ব্যক্তি যে অন্যের বিনোদনের জন্য নিজেকে হাস্যকর ও অদ্ভুত করে তোলে। আজ ফেসবুকে ঠিক এটাই হচ্ছে। মানুষ ভিউ আর ফলোয়ারের জন্য নিজেদের মান, মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে তুচ্ছ করে নানা ধরনের উদ্ভট কাজ করছে। কেউ পাবলিক প্লেসে অদ্ভুত পোশাক পরে নাচছে, কেউ অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করছে, আবার কেউ কেউ মিথ্যা খবর বা গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই— বিতর্ক বা চমক সৃষ্টি করে দ্রুত সবার নজরে আসা, যাতে মনিটাইজেশনের শর্তগুলো পূরণ করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে না যে তারা শুধু অর্থই উপার্জন করছে না, বরং নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সম্মান এবং আত্মসম্মানকে বিকিয়ে দিচ্ছে।
এই মনিটাইজেশনের আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি সাধারণ ব্যবহারকারীদেরও প্রভাবিত করছে। মানুষ যখন দেখে যে অদ্ভুত বা বিতর্কিত কনটেন্ট দিয়ে একজন ব্যক্তি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে, তখন তারাও একই পথে হাঁটতে উৎসাহিত হয়। ফলে আমাদের নিউজফিড ভরে যায় মানহীন, উদ্ভট এবং প্রাইভেসি-হানিকর কনটেন্টে। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক ডিজিটাল পরিবেশের পরিবর্তে আমরা এমন একটি পরিবেশে বাস করছি, যেখানে সবকিছুই ভিউ এবং রিঅ্যাকশনের ওপর নির্ভরশীল। এখানে ভালোবাসার চেয়ে লাইক বেশি জরুরি, সম্মানের চেয়ে ফলোয়ার বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং সত্যের চেয়ে সেনসেশন বেশি মূল্যবান।
এই সমস্যার সমাধান কী? সমাধান এক দিনে আসবে না। প্রথমত, আমাদের নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। অর্থ উপার্জনের জন্য নিজের সবটুকু বিকিয়ে দেওয়া যে কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তা বুঝতে হবে। আমাদের কনটেন্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে। আমরা যদি মানহীন ও উদ্ভট কনটেন্টকে উৎসাহ না দিই, তাহলে সেসব কনটেন্ট তৈরি করার প্রবণতাও কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোকেও তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু ভিউ বা রিঅ্যাকশনের ওপর ভিত্তি করে মনিটাইজেশন না দিয়ে কনটেন্টের গুণগত মান, শিক্ষাগত মূল্য এবং সামাজিক প্রভাবকেও বিবেচনা করা উচিত।
ফেসবুক মনিটাইজেশনের লোভ আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার ওপর এক বড় আঘাত। এটি আমাদের সবাইকে এক উন্মুক্ত মঞ্চের জোকারে পরিণত করছে। এই প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তাহলে হয়তো একসময় আমরা এমন এক সমাজে বাস করব যেখানে ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সংজ্ঞা থাকবে না, এবং প্রতিটি সম্পর্ক ও আবেগ শুধুমাত্র লাইক, শেয়ার এবং ভিউয়ের বিনিময়ে কেনা-বেচা হবে। এটি একটি ভয়াবহ বাস্তবতা, যার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং নিজেদের প্রাইভেসি রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।